প্রকাশিত: Sat, Feb 4, 2023 4:02 PM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 6:43 PM

জহির রায়হান বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যিনি হয়তো কথাশিল্পী হতেন না; যদি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন না ঘটতো

রাজিক হাসান : জহির রায়হান বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যিনি হয়তো কথাশিল্পী হতেন না; যদি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন না ঘটতো। তাই জহির রায়হানের আরেকটি পরিচয় তিনি একজন ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলনে তার অবদান বহুমুখী। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে কাঁচের দেয়াল শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এবং তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার হিসেবে পুরস্কার পান। সে উৎসবে সর্বোচ্চ সংখ্যক পুরস্কারও তিনি পেয়েছিলেন।

জহির রায়হান তখন ব্যতিক্রমধর্মী সিনেমার পরিচালক। বিভিন্ন কারণেই একসময় তিনি বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা তৈরি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সত্তরের জানুয়ারিতে তিনি নিজেই বলেন, এ বছরের মধ্যে নতুন ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি করতে না পারলে আপন বিবেকের কাছে প্রতারক সাব্যস্ত হবো। একসময় আমার আর্থিক সংকট ছিল বলে সৃজনশীল ছবির বদলে বাণিজ্যিক ছবির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এখন সে সামর্থ্য এসেছে। তাই আমার স্বপ্ন ও সাধ নিয়ে ছবি তুলবার সময় উপস্থিত।

ছবি নির্মাণকালে পাকিস্তানিদের নজরে পড়েন কলাকুশলীরা। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জহির রায়হানকে। পরে জহির রায়হানকে মুক্তি দিলেও নির্দিষ্ট সময়ে ছবি মুক্তি না দেওয়াতে জনগণ আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। ‘জীবন থেকে নেয়া’ খুব সম্ভবত একমাত্র চলচ্চিত্র যার মুক্তির জন্য হাজার হাজার মানুষ মিছিল করেছে, স্লোগান দিয়েছিল। ছবি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। ১৯৬৯ সালের ঘটনা। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে তখন। জহির রায়হান একদিন আমজাদ হোসেনকে ডেকে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখতে বললেন। গল্পটা হবে এমন যেখানে এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়াবে। আমজাদ হোসেন লেখাও শুরু করে দিলেন। তবে প্রথম দৃশ্যটা ছিল এ রকমÑএক বোন আরেক বোনকে দুধভাত খাওয়াচ্ছে। জহির রায়হান জিজ্ঞেস বললেন, খাওয়াতে বললাম বিষ, আর খাওয়াচ্ছেন দুধ। আমজাদ হোসেন বলেন, আরে, দুধ না খাওয়ালে বিষ খাওয়াব কীভাবে?

‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির কাহিনিটি ছিল একটি পরিবার নিয়ে। ভাই ও বোন, ভাইয়ের বউ, বোনের বর , আর একটা চাবির গোছাÑ এই চার জন সদস্য নিয়েই সে পরিবার। কিছুক্ষণ পর সেই পরিবারই হয়ে ওঠে একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন, একটি চলচ্চিত্র। জহির রায়হান সিনেমায় এনেছিলেন নায়িকা ববিতাকে। তাঁর মতো গুণী মানুষের হাত ধরে ববিতা চলচ্চিত্র জগতে এসেছিলেন। সত্যজিৎ রায় ‘অশনি সংকেত’ করার সময় ববিতাকে বলেছিলেন, ‘তোমার দুলাভাই বড় মানের পরিচালক! তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ অসাধারণ একটি সিনেমা। হাজার বছর ধরে, শেষ বিকেলের মেয়ে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী আজও তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে পাঠকের কাছে। তাঁর লেখা ছোট গল্পও বাংলা সাহিত্যে বড় জায়গা করে নিয়েছে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি একজন দেশ সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক। 

‘স্টপ জেনোসাইড’ অর্থাৎ ‘বন্ধ কর গণহত্যা’Ñ  জহির রায়হান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে ১৮ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এই তথ্যচিত্রটি তৈরি করেন। জহির রায়হান একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই তথ্যচিত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, চলমান গণহত্যা ও মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার জন্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সহকারী আলমগীর কবিরকে সাথে নিয়ে তিনি স্টপ জেনোসাইড এর কাজ শুরু করেন। মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও চলচ্চিত্র বিভাগ আর্থিকভাবে সহায়তা করতে সম্মত হয়। কিন্তু পরে এই ছবিটি নিয়ে প্রবাসী সরকারের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্ট হয়; কারণ ছবিটির কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নেই।

পরে তাজউদ্দীন আহমদ-সহ অন্যরা পরিস্থিতি সামাল দেন। ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয় এক অজ্ঞাত স্থানে, যেখানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার ক্ষেত্রে ‘স্টপ জেনোসাইড’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে শিল্পগত সাফল্যের দিক থেকে এই চলচ্চিত্রটির স্থান শীর্ষে। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে নিখোঁজ হন জহির রায়হান। তারপর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁকে। ফেসবুক থেকে